গ্রাম থেকে গ্রামে

এক্সপ্রেস এন্ট্রি প্রোগ্রামে আমরা আমাদের স্কুল (জিয়া হাসান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল) থেকে আবেদন করেছিলাম ২০১৬ সালে। মৌলি, আমার স্ত্রী এই স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল এবং সিনিয়ার টিচার হিসেবে আবেদন করেছিল মূল আবেদনকারী হিসেবে। সাড়ে সাত মাসে আমাদের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। কোন ইন্টারভিউ লাগে নি, এমনকি স্কুলে কোন খোঁজখবরও করা হয়নি আমাদের জ্ঞাতসারে। বাংলাদেশের গ্রামের একটি স্কুল থেকে আবেদন করে এত দ্রুত সবকিছু হয়ে যাওয়ায় একটু অবাকও হয়েছিলাম। পরে মনে হয়েছে আইইএলটিএস পরীক্ষায় ভাল স্কোর এবং কাগজপত্র সব নির্ভেজাল, নির্ঝঞ্ঝাট থাকলে আবেদনকারী পৃথিবীর কোন দেশের কোন গ্রাম থেকে আবেদন করছে তাতে কানাডা সরকারের কিছু যায় আসে না।
সেই উপলদ্ধি থেকেই আমার ইউটিউব চ্যানেল শুরু করা, কারণ আমার মনে হয়েছে যারা কানাডা ইমিগ্রেশনে আগ্রহী তাদের স্পষ্টভাবে এই মেসেজটা দেয়া দরকার, আপনার প্রয়োজনীয় যোগ্যতাটুকু থাকলে (আইইএলটিএস পরীক্ষায় ভাল স্কোর, মাস্টার্স ডিগ্রী এবং ৩/৪ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা) এবং কাগজপত্র সব ঠিক থাকলে আপনার বেলাতেও এত দ্রুতই সব হয়ে যাবে। সারা দেশ থেকে পেশাজীবীদের সাড়া দেখে আমি অভিভূত। ইতোমধ্যেই চল্লিশ হাজার-এর বেশি মানুষ চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করেছেন এবং প্রতিদিন দু’শোর বেশি সংখ্যক মানুষ নতুন সাবস্ক্রাইবার হচ্ছেন। এটা প্রমাণ করে যে, প্রচুর সংখ্যক পেশাজীবী কানাডা ইমিগ্রেশনে আগ্রহী এবং তারা একটু সঠিক তথ্য কিংবা খবরের জন্য উন্মুখ থাকেন। আমাদের বেলায়, অর্থাৎ ২০১৬ তে বাংলাদেশিদের জন্য বাংলা ভাষায় এক্সপ্রেস এন্ট্রি বিষয়ক তথ্য, পরামর্শ দেয়ার নির্ভরযোগ্য কোন ভিডিও আমি খুঁজে পাইনি। তাই এখানে এসে মনে হয়েছে, এক্সপ্রেস এন্ট্রি যে কঠিন কিছু নয় সেটা দেশি ভাইবোনদের জানানো দরকার, পাশাপাশি এটাও জানানো দরকার
এখানে সেটল্ করাও আবার এত সহজ বিষয় নয়। চাকরির বাজারের প্রয়োজনীয় দক্ষতা বিশেষ করে কমিউনিকেটিভ ইংলিশে খুব ভাল না হলে মূল ধারার জব মার্কেটে জায়গা পাওয়া কঠিন, তখন অড জব করতে হবে। ইংরেজিটা ভাল করে রপ্ত করে এখানে এসে নিজের কাজের প্রকার অনুযায়ী একটা সার্টিফিকেট কিংবা ডিপ্লোমা কোর্স করে জব মার্কেটে নামলে তখন আর অসুবিধা হবে না। গ্রামের স্কুলের টিচার হিসেবে আমাদের যখন হয়েছে তখন সারা বাংলাদেশের ৮৭,০০০ গ্রামের যে কোন টিচারেরই এটা হতে পারে এবং হবে যদি তাদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতাটুকু থাকে। আমাদের স্কুলের আরও টিচারদের আমরা এক্সপ্রেস এন্ট্রির জন্য প্রস্তুত হতে সহায়তা করছি। ৮৭,০০০ গ্রামের, ৪৫০০ ইউনিয়নের যোগ্য পেশাজীবীদের এই তথ্য জানানো, সাহস জোগানো এবং অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যেই আমার ইউটিউব চ্যানেলের পথচলা। লাখ লাখ বেকার গ্র্যাজুয়েট এখন দেশে। কানাডা তিন বছরে দশ লাখ ইমিগ্র্যান্ট নেবে। আমাদের দেশ থেকে দশ হাজার পেশাজীবীও এখানে আসতে পারলে দেশে দশ হাজার নতুন চাকরির জায়গা তৈরি হবে। দেশের জন্য এটা দুদিক থেকেই লাভ।
ইউটিউব চ্যানেলের অভিজ্ঞতা একদম অন্যরকম একটি অভিজ্ঞতা। মানুষের সাড়ায়, ভালবাসায়, দোয়ায় আমি সত্যিই অভিভূত। এমনভাবে অনেকে দোয়ার কথা লেখেন যে পড়ে চোখে পানি চলে আসে। বয়স পঞ্চাশের কাছে চলে এলে মনে হয় আবেগাক্রান্ত হবার প্রবণতাও বেড়ে যায় মানুষের। গত বছরের শেষের দিকে টরেন্টো থেকে একজন লিখলেন ‘পরম করুনাময়ের দয়ায় এবং আপনার গাইডেন্সে এক্সপ্রেস এন্ট্রির মাধমে গত সপ্তাহে কানাডায় ল্যান্ড করলাম। ভাল থাকবেন জিয়া ভাই!’ পড়ে মনে হল, না দেখা এই মানুষটি হঠাৎ করে খুব কাছের মানুষ হয়ে গেল। গত সপ্তাহে লন্ডনের একটি সংস্থার বাঙ্গালী ম্যানেজার জানালেন তার পরিচিত মহলের কমপক্ষে তিনজন শুধুমাত্র এই ভিডিওগুলো দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এক্সপ্রেস এন্ট্রি প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। কেউ যখন লেখেন ‘আপনার কথা আমার জন্য টনিকের মত কাজ করে’ সেটি একইভাবে আমার জন্যও টনিকের কাজ করে। গত বছর নভেম্বরে ঢাকা যাবার আগে পোস্ট দিয়েছিলাম টি এস সিতে একদিন বিকেলে জনা পঞ্চাশেক নিয়ে আড্ডা দেব। দেখা গেল প্রায় দুশো জন হাজির। তিনজন ঢাকার বাইরের তিন জেলা থেকে এসেছেন। ‘ভোরের বাস ধরে এসেছি আপনাকে দেখার জন্য, আড্ডা দেবার জন্য, আবার সন্ধ্যার বাসে ফিরে যাব’ – আমার মত অতি সাধারণ মানুষের এ এক অতি অসাধারণ পাওয়া। জয়তু ইউটিউব! কত শাখাপ্রশাখায় মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক তৈরি হয়!
কানাডা শব্দটির উৎপত্তি ‘কানাটা’ থেকে। কানাটা মানে গ্রাম। পৃথিবীর সব থেকে বড় গ্রামটির নাম কানাডা। আমি গ্রামের ছেলে। বাংলাদেশের একটি গ্রামে জীবনের প্রথম ১৯ বছর কাটিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। ৩৮ বছর বয়সে গ্রামে ফেরত গিয়েছি গ্রামের শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে, ৪৮ বছর বয়সে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্রামটিতে এসেছি কিছু শেখার জন্য। আমি যে বাড়িটিতে এখানে থাকি সেটার নামও ‘ওয়েস্টব্রুক ভিলেজ’। ৫২ বছর বয়সে গ্রামের ছেলে আবার গ্রামে ফেরত যাব এবং আরও একটু বড় আকারে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবো ইনশা আল্লাহ্‌। ভালবাসার এই মানুষগুলো তখনও তাদের ভালবাসা নিয়ে, দোয়া নিয়ে পাশে থাকবেন আশা করি।

জিয়া হাসান
শিক্ষক
এডমনটন, কানাডা
ইমেইল : ziahasan69@gmail.com

Comment List

  • Jahedul 26 / 05 / 2019

    সাততার সম্মান চিরদিনের এবং গ্রহণযুগ্যতা সবার উপরে .
    লেখাটা পড়ে শান্তি পেলাম .

    Reply
  • sheik farid 09 / 06 / 2019

    আস্সালামু আলাইকুম।
    ভাইয়া আপনার লেখাটা পড়ে অনুপ্রানিত হলাম।ধন্যবাদ।

    Reply
  • Sojib Ahmed 03 / 07 / 2019

    প্রিয় স্যার….
    আপনার কথা গুলো যাদুর মতো আমার ভেতরে কাজ করে…
    আমি আমার সকল বিসিএস, জব স্টাডি ফেলে রেখে কানাডায় স্কলারশিপ নিয়ে আসতে প্রস্তুতি নিচ্ছি, এটা করুণাময়ের দয়া ও আপনার চমৎকার অনুপ্রেরণা।
    ভালো থাকবেন স্যার…
    আপনাকে স্বচোক্ষে দেখার প্রতিক্ষায়….
    সজীব আহমেদ
    ভালুকা ময়মনসিংহ

    Reply
  • MahmudunNabi Mehedi 21 / 07 / 2019

    অনেক অনেক শুভ কামনা রইলো জিয়া ভাইয়া ! আল্লাহ আপনার সহায় হোক ! অনেক ভাল থাকবেন !

    Reply

Leave a Reply