আমাদের করটিয়ার শৈশব এবং একজন সংগঠকের গল্প

সকাল দশটা থেকে বেলা চারটে পর্যন্ত স্কুল। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত। মাঝখানে লাঞ্চ ব্রেকে দৌড়ে বাসায় এসে খেয়ে যাওয়া। ৪টায় বাসায় ফিরে ব্যাগ রেখেই খেলার মাঠে ছোটা। কখনো কলেজ মাঠে, কখনো স্কুল মাঠে, আবার কখনো আমাদের বাড়ির মাঠে খেলতাম। বাড়ির মাঠটাও মোটামুটি বড়ই ছিল, প্রায় দুই বিঘার মত। সাত চারা এবং থ্রি টু ফাইভ সাইডেড ক্রিকেট ম্যাচ, ছোট গোলপোস্টে ফুটবল ইত্যাদি খেলার জন্য আমাদের নিজেদের মাঠটাই উপযুক্ত ছিল। সাত চারা খেলার সাথে কেউ পরিচিত কিনা জানিনা। এটি বাংলাদেশের গ্রামের একটি খেলা এবং খুব মজার খেলা। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিকেলবেলা কোনদিন ফুটবল, কোনদিন ক্রিকেট, কোনদিন সাতচারা ইত্যাদি নানা রকম খেলতাম। ক্লাস নাইনে উঠার পর এলাকার এক বড় ভাই (বাবু চৌধুরী) আমাদের ব্যাচটাকে সংগঠিত করে ক্রিকেটের প্রশিক্ষণ দিলেন এবং টাঙ্গাইল জেলা নির্মাণ লীগে অংশগ্রহণের জন্য আমাদের স্কুলের নাম লেখালেন। আমরা ছয় মাসের বেশি সময় নিবিড় ভাবে প্রশিক্ষণ নিলাম। করটিয়া কলেজের মাঠে বিকেলে আমরা গোটা বিশেক ছেলে ধবধবে সাদা শার্ট-প্যান্ট, টাই, কেডস পরে যখন প্র্যাকটিসে নামতাম, মাঠের চারপাশে তখন লোক জড়ো হয়ে যেত আমাদের খেলা দেখার জন্য। ফাইনালি টাঙ্গাইল স্টেডিয়ামে নির্মাণ লীগে খেলা শুরু করলাম আমরা। টাঙ্গাইলের কেউ আমাদের চেনে না। গ্রাম থেকে আসা টিম, খুব একটা পাত্তাও দিতে চায় না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমরা নির্মাণ লীগে রানারআপ হলাম। একটি ম্যাচে আমি ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হলাম। জাতীয় পত্রিকাগুলোর খেলার পাতার এক কোনায় নিজের নাম দেখে সেকি উত্তেজনা! খুব সম্ভবত ১৯৮৪ সালের ঘটনা এটি। বাবু ভাই আমাদের জীবনে সেই সময় যে কি মহামূল্যবান ভূমিকা পালন করেছিলেন সেটা বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি। পড়াশোনার বাইরে সেই সময়টায় ধ্যানে জ্ঞানে ক্রিকেট ঢুকে যাওয়ায় অন্য কিছু চিন্তা করার ফুরসতই পাইনি। সেই সময়টায় একজন অভিভাবক হিসেবে, বড় ভাই হিসেবে উনার ভূমিকা আমি জীবনে ভুলবো না। উনি আমাকে কি পরিমান আদর করতেন তার একটি নমুনা দেই। ১৯৮৬ আমি পাঁচ সাবজেক্টে লেটার নিয়ে এসএসসি পাস করলাম। বাবু ভাই তার কয়েক মাস আগে জাপানে গেছেন। ওখান থেকে রেজাল্ট শুনে উনি আমাকে ২৫০০ টাকা পাঠালেন সাথে ছোট্ট একটি নোট, ‘রেজাল্ট শুনে খুব খুশি হয়েছি। নিজের পছন্দের কিছু কিনে নিও।’ ১৯৮৬ সালে গ্রামের একটি ছেলের হাতে গিফট হিসেবে ২৫০০ টাকা! চিন্তা করুন অবস্থা। আমার জীবনের প্রথম এত বড় অংকের গিফট। করটিয়ায় আমার কৈশোরের এবং তারুণ্যের যে সময়টুকু সেটাকে সুশৃংখলভাবে, ঠিক পথে থেকে পার হতে সহায়তা করেছে বাবু ভাইয়ের মত একজন এলাকার বড় ভাই, একজন বড় মনের মানুষ এবং একজন সফল সংগঠক। এই লেখার মধ্য দিয়ে অন্তরের অন্তস্থল থেকে বাবু ভাইকে জানাচ্ছি কৃতজ্ঞতা এবং শ্রদ্ধা। দেশের সব পাড়া-মহল্লাতেই একসময় বাবু ভাইদের মত ‘ছোট ভাইদের আদর- ভালোবাসা-শাসনে আগলে রাখা’ বড় ভাইরা ছিলেন, সংগঠকরা ছিলেন। এখন মনে হয় তার প্রকট অভাব। কারও জন্য কারও সময় নেই।

Leave a Reply