গ্রামাঞ্চলের আলোকিত মানুষেরা

২০১৩ সালের কথা। ঢাকা-টাঙ্গাইল হাইওয়ে থেকে গাড়ি যখন করটিয়া বাইপাসে টার্ন নিল তখন সা’দত কলেজ মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে এলো। রাতে ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছিলাম। রাস্তায় একটি ট্রাক উল্টে কালিয়াকুরে ভয়ঙ্কর যানজট তৈরি হয়। ফলে সারারাত রাস্তায় বসে থাকা। ডিনার করে একটু দেরিতে রওনা দিলে সাধারনত মহাসড়ক ফাঁকা পাওয়া যেত এবং মোটামুটি আড়াই ঘণ্টায় মোহাম্মদপুর ইকবাল রোডের বাসা থেকে করটিয়ার বাড়ির দরজায় পৌঁছে যেতাম। কিন্তু মাঝে মাঝেই এই অনাকাঙ্ক্ষিত যানজটের মুখোমুখি হতে হতো। যাইহোক, কাকডাকা ভোরে আজান শুনতে শুনতে করটিয়া প্রবেশের মুহূর্তটি ভালো লাগছিল। আজান দিচ্ছিলেন মুয়াজ্জিন জনাব হালিম মুন্সী। হঠাৎ মনে হল, এই ভদ্রলোকের আজান শুনতে শুনতেই আমরা দুটো বা তিনটে জেনারেশন করটিয়ায় বড় হলাম। এই নিঃস্বার্থ, পরোপকারী মানুষটিকে একবার ধন্যবাদ জানানো উচিত আমাদের জেনারেশনের পক্ষ থেকে। আমি উনাকে ছোটবেলা থেকেই চিনতাম। পাড়ার মুরুব্বী। খুবই স্বল্পভাষী, সজ্জন একজন মানুষ। করটিয়া পৌঁছে সারাদিন স্কুলের কাজ করে বিকেলবেলা উনার ছেলেকে ফোন করলাম। ছেলের নাম বাবুল। করটিয়া বাজারে তার লেপ-তোষকের দোকান আছে। বাবার মতোই সৎ এবং ধার্মিক একজন মানুষ। বাবুলকে বললাম, তোমার বাড়িতে যাব। হালিম চাচার সাথে দেখা করতে চাই। বাবুল বলল, ভাইয়া আপনাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। আমি কালকে সকালে আব্বাকে নিয়ে আপনার অফিসে আসবো। আমি মেনে নিলাম। পরদিন সকাল ১১টার দিকে বাবুল তার বাবাকে নিয়ে আমাদের স্কুলের অফিসে আসলো। শুদ্ধ আত্মার মানুষের সাথে আপনি যখন বুক মেলাবেন তখন সেটা টের পাবেন। অনেক বছর পর হালিম চাচাকে দেখলাম। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আমি প্রতিমাসে একবার করটিয়া গিয়ে ৭/৮ দিন করে থাকতাম স্কুলের কাজে কিন্তু স্কুলের কিংবা বাড়ির বাইরে যেতাম না। বছরে হয়তো সর্বোচ্চ একদিন কিংবা দুদিন বাজারে গিয়েছি। বাড়ির কমপাউন্ডেই জমি ওয়াকফ করে ২০০৯ সালে জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠার পর জামাতে নামাজ কিংবা জুমার নামাজের জন্য আর কলেজ মসজিদ কিংবা বড় মসজিদে যাওয়া হতো না।
যার ফলে হালিম চাচাকে অনেক বছরই সামনাসামনি দেখা হয় নাই কিন্তু করটিয়া গেলেই উনার সুমধুর আজান শোনা হতো। বয়সের ছাপ হালিম চাচার শরীরে। বললাম, হালিম চাচা, কালকে ভোরে আপনি যখন আযান দিচ্ছিলেন তখন আমরা করটিয়া পৌছলাম। হঠাৎ করে আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হলো। আপনার আজান শুনতে শুনতেই আমরা করটিয়ায় বড় হলাম। যুগ যুগ ধরে আপনি গায়ে-গতরে খেতে এই সদকায়ে জারিয়ার কাজটি করে যাচ্ছেন। করটিয়াবাসীর পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা। একটা খাম উনার হাতে দিয়ে বললাম, এখানে সামান্য কিছু টাকা আছে। আমি জানিনা আপনি কি খেতে পছন্দ করেন। এটা দিয়ে আপনার পছন্দের খাবারটা খেলে আমি খুব খুশি হব। হালিম চাচা এমনিতেই খুব চুপচাপ স্বভাবের মানুষ। মনে হল আরও চুপ হয়ে গেলেন, খানিকটা অপ্রস্তুতও। এক মুহূর্ত মাথা নিচু করে বসে রইলেন। সম্ভবত চোখের পানি সামলালেন। যখন আমার দিকে তাকালেন তখন উনার চোখের কোনে পানির পাশাপাশি আমি যে ভালোবাসা আর আদর দেখতে পেলাম তা অতুলনীয়। এমন শুদ্ধ মানুষকে সামনাসামনি দেখতে পাওয়া এবং স্পর্শ করতে পারা সত্যিই ভাগ্যের বিষয়। আলহামদুলিল্লাহ! খুব সম্ভবত পরের বছর হালিম চাচা মারা যান। ঠিক সেই সময়টায় আমি করটিয়ায় ছিলাম না, যার ফলে জানাজায় অংশগ্রহণ করা হয়নি কিন্তু যারা অংশগ্রহণ করেছে তাদের অনেকেই আমাকে পরে বলেছে করটিয়ায় তারা জীবনে কখনও এত বড় নামাজে জানাজা দেখেনি। করটিয়া একজন অভিভাবক হারাল, মানুষের বেশে একজন ফেরেশতাকে হারাল। হালিম চাচাকে যারা চিনতেন তারা সবাই একবাক্যে এটা মানবেন।
সব গ্রামেই হালিম চাচার মত কিছু চরিত্র থাকে যারা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থেকে নিরলসভাবে, অক্লান্তভাবে গ্রামবাসীর সেবা করে যায়। আমার মত যারা গ্রামে বড় হয়েছেন তাদের কাছে অনুরোধ, একটু সময় বের করে আপনার গ্রামের হালিম চাচাদের কাছে যান, বুক মেলান এবং তাদের দোয়া নিন।

Leave a Reply