আয়োজন করে বিদায় নেয়া

আমার ৪৯ বছরের জীবনে, পরিচিত মানুষের মধ্যে আমি মাত্র দু’জন মানুষের কথা শুনেছি যারা দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে ঘোষণা দিয়ে, আয়োজন করে বিদায় নিয়েছেন। আমার মেজ চাচা তাদের একজন। ১৯৯৮ সালে এই দিনে উনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। কয়েক মাস ধরে ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ফুসফুসের ক্যান্সার, টার্মিনাল স্টেজ চলছিলো। শেষ পর্যায়ে এসে উনার ভোকাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্ত হল। সেই ভরাট, গমগমে আওয়াজ আর নেই। চোকড্ ভয়েসে উনি কষ্ট করে একটু একটু কথা বলতেন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া (কিংবা হয়ত তখন পাশ করে গেছে) দুই জমজ মেয়ে মোটামুটি ২৪ ঘণ্টাই তখন তাদের বাবার পাশে বসে থাকতো পালাক্রমে। পাশাপাশি তাদের মা, বড় ভাই-এর সার্বক্ষণিক সহযোগিতা তো আছেই। বাবার সাথে মেয়েদের এমন নিবিড় বন্ধুত্ব হতে পারে সেটা আমি ওদের না দেখলে জানতামই না হয়ত। ছোটবেলায় মেজ চাচার বাসায় যখন বেরাতে যেতাম, মুগ্ধ হয়ে ওদের গল্প, কার্যকলাপ দেখতাম। চাচা লিভিং রুমের মেঝেতে কার্পেটে উপর হয়ে শুয়ে আছেন, এক মেয়ে পিঠে হাঁটাহাঁটি করছে, আর একজন মাথার কাছে বসে একশত মাইল স্পিডে গল্প বলে যাচ্ছে। মেজ চাচাও সমান তালে আগ্রহ নিয়ে সেই আড্ডায় অংশগ্রহণ করছেন। অদ্ভুত দৃশ্য, আমার চোখে পানি চলে আসতো। মনে হত, আমার বোন নেই কেন, সেও তাহলে আব্বার সাথে এমন গল্প করত! আল্লাহ্‌ আমাকে একটি রাজকন্যা উপহার দিয়েছেন, যার সমস্ত গল্পের সবচেয়ে মনযোগী শ্রোতা এখন আমি।

শেষ দিকে মেজ চাচার টানা ঘুম হত না। দুই মেয়ে পালা করে বাবার মাথার কাছে বসে থাকতো। ভোর রাতের দিকে চাচার হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, “মা, কে আমার পাশে এসে বসলো?”
মেয়ে বলল, “কেউ না তো আব্বু!”
“তুমি জান না। যাও তোমার মা, ভাই, বোনকে ডাক দাও। দাদাকে ফোন করে আসতে বল।”
দাদা হচ্ছেন আমার বড় চাচা, যিনি ছিলেন মেজ চাচার সব থেকে প্রিয় ভাই। কাছেই থাকতেন, পরিবাগ ওয়াপদা কলোনিতে। ইস্কাটন থেকে ১৪/১৫ মিনিটের হাঁটা পথ। বড় চাচাকে ফোন করা হল। উনি বুঝে গেলেন। উনার ফ্ল্যাটের নিচে ড্রাইভারদের থাকার ব্যবস্থা। উনি ড্রাইভার ডেকে এক সেকেন্ড নষ্ট করতে চাইলেন না। প্রাতঃভ্রমণের জন্য বের হচ্ছিলেন, সেই পোষাকেই বেড়িয়ে রাস্তা দিয়ে দৌঁড়াতে লাগলেন আর দোয়া করতে লাগলেন উনার জীবনের চাইতেও প্রিয় এই ভাইটিকে যেন শেষবারের মত দেখতে পান, একটু কথা বলতে পারেন। ভুলে গেলেন তাঁর নিজের শরীরও খুব ভাল নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পরের বছর উনি ক্যান্সারে মারা যান এবং তার ২ বছর পর আমার বাবা ক্যান্সারে মারা যান।
দুই জমজ কন্যা, পুত্র এবং স্ত্রী সবাই চাচাকে ঘিরে বসলো। মেয়েদের সহায়তায় উনি ২০ দিন পর শোয়া থেকে একটু উঠে বসলেন। প্রিয় মিষ্টি খেতে চাইলেন, প্রিয় ফল পেপে খেলেন একটু, সাথে একটু পানি। জানতে চাইলেন দাদাকে খবর দেয়া হয়েছে কিনা। আবার শুয়ে পরলেন এবং দুই পাশে বসা তার দুই মেয়ের হাত শক্ত করে ধরে রইলেন । সবাইকে দোয়া পড়তে বললেন জোরে জোরে। চাচা চুপচাপ শুয়ে আছেন, চোখের কোল বেয়ে পানি পড়ছে। কলিং বেল বেজে উঠলো, আর ঠিক তখুনি দুই মেয়ে টের পেল চাচা হাতের চাপ ছেড়ে দিয়েছেন। ১৯শে অক্টোবর, সোমবার ভোর ৫টার দিকে চাচা স্রষ্টার কাছে ফেরৎ গেলেন। ইস্কাটন, দিলু রোডের মসজিদ গুলোতে ফজরের আজান শুরু হল। (শেষ মুহূর্তের বর্ণনাটুকু আমি টুইন কাজিনদের একজনকে আজ ফোন করে মিলিয়ে নিয়েছি।)

আমাদের পরিবার মানুষ হিসেবে একজন ফেরেশতাকে পেয়েছিল পরিবারের সদস্য হিসেবে; আমরা তাকে হারালাম। উনি অগ্রণী ব্যাংকের জিএম ছিলেন। পুরো বাংলাদেশের অগ্রণী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এখনো একনামে কে, এস, রহমানকে চেনে তাঁর অকল্পনীয় পর্যায়ের সততা, পেশাগত দক্ষতা এবং শিক্ষার জন্য। আমি যে কি ভয়ানক মিস করি উনাকে এটা বলে বোঝানো যাবে না! আমার জন্য উনি ছিলেন একটি জীবন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখান থেকে আমি অনবরত শেখার চেষ্টা করতাম। উনার সাথে সময় কাটানো মানেই ছিল নতুন কিছু জানা বা শেখা বা উপলদ্ধি করা। ক্যান্সার টার্মিনাল স্টেজে পৌছার আগেও আমি উনাকে দেখেছি লিভিং রুমের মেঝেতে কার্পেটে শুয়ে টাইমস ম্যাগাজিন পড়তে। আমার গ্রাম থেকে এসে নিজের চেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া এবং পড়াশোনা শেষ হবার পর কারও সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা, এসব ব্যাপারগুলো খুব পছন্দ ছিল চাচার। তাঁর সাথে আমার বন্ধুত্বের পর্বটা কেবল শুরু হয়েছিল।
পরম করুণাময়, আপনার এই প্রিয় বান্দাটিকে আপনি আপনার ছায়ার তলে রাখুন এবং উনার পরিবারের সদস্য হিসেবে আমরা সবাই যেন উনার আদর্শে বেড়ে উঠতে পারি সেই তৌফিক দান করুন। আমীন!

Leave a Reply