আমাদের আজিজ মামা

আজিজ মিয়া আমাদের স্কুলে সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে যোগদান করে খুব সম্ভবত ২০১২ সালে। সে এককালে গ্রামে যাত্রাপালা করতো। যার ফলে তার সবকিছুর মধ্যেই খানিকটা নাটকীয় ভাব আছে। যোগদানের পর আজিজ মিয়া লক্ষ্য করল এটা ইংলিশ ভার্সন স্কুল, সবাই বেশিরভাগ কথাবার্তা ইংরেজিতে বলছে। সুতরাং আজিজ মিয়া সিদ্ধান্ত নিল তারও টুকটাক ইংরেজি বলা উচিত, না হলে আর মান ইজ্জত থাকছে না। তারই ধারাবাহিকতায় একদিন স্কুলের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু বাচ্চাকে নাটকীয় ভঙ্গিতে বিকট শব্দে চিৎকার করে বললো, ‘গু গু’। আসলে সে বলতে চেয়েছিল ‘গো গো।’ সাথে সাথে বাচ্চারা ছিটকে দূরে সরে গেল এই ভেবে যে নিশ্চয়ই আশেপাশে কোথাও ঐটাই পড়ে আছে। আর আজিজ মিয়া ভাবলো, যাক, ইংরেজি একদম সঠিক হয়েছে কারণ বাচ্চারা সাথে সাথে সরে গেছে। এভাবেই আজিজ মিঞার শুরু।
তার অন্যতম কাজ হচ্ছে স্কুলের ফ্রন্ট অফিসের ফাইফরমাশ খাটা, স্কুলের বাজার-সদাই করা ইত্যাদি। এরমধ্যে তার সব থেকে প্রিয় কাজ হলো বাজার সদাই-এর অংশটি, কারণ প্রতিবার বাজার করতে যাওয়া মানে তার একবার বাইরে যাওয়া এবং প্রতিটি দোকানেই ২/৪ মিনিট বেশি কাটানো। পান খেয়ে বাজারের রাস্তায় একটু হাঁটাহাঁটি, পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হলে তাকে বোঝানোর চেষ্টা সে যে কত ব্যস্ত একজন মানুষ, স্কুলের সমস্ত দায়-দায়িত্ব তাকেই পালন করতে হয় ইত্যাদি তার অন্যতম প্রিয় কাজ। কাজ কম করে কিভাবে নিজেকে অসম্ভব ব্যস্ত রাখা যায় সেটাকে আজিজ মিয়া মোটামুটি একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। কয়েকবছর আগের ঘটনা। ডিসেম্বর মাসের কোন এক বিকেলে যখন স্কুল থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবো তখন দেখা গেল গাড়ির ব্যাটারি ডাউন। আরেক সাপোর্ট স্টাফ সালামকে বললাম চারতলা থেকে আইপিএস-এর ব্যাটারিটা খুলে নিয়ে আসতে। ওই ব্যাটারির সাহায্যে গাড়ি স্টার্ট করা যায় কিনা সেটা দেখতে চাচ্ছিলাম। স্কুলের মাঠের কিনারে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পর আমি লক্ষ্য করলাম, সালাম মাথায় করে ব্যাটারি নিয়ে আসছে আর আজিজ মিয়া খালি হাতে পাশে দৌড়াচ্ছে। খুব অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, আজিজ মিয়া আপনি দৌড়াচ্ছেন কেন? সে বলল, “না স্যার, সালাম ব্যাটারি নিয়ে আইলো তো, তাই আমি ভাবলাম সাথে একটু আহি।”
এই হচ্ছে আমাদের আজিজ মিয়া। স্কুলের সব টিচারদের প্রিয় ‘আজিজ মামা’। ব্যক্তিগত জীবনে সে একজন সৎ এবং চমৎকার মানুষ। স্কুলটিকে সে বুকের মধ্যে ধারণ করে। স্কুল বিষয়ে যে কোন আলোচনায় সে বলে ‘আমাদের স্কুল’। প্রতিবছর দেশে আসার সময় মৌলি আজিজ মিয়ার জন্য এক কৌটা ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট দিয়ে দেয়। আমি পরে যেন ভুলে না যাই সেই জন্য কৌটার গায়ে লিখে দেয় ‘আজিজ ভাই’। আমি যখন আজিজ মিয়াকে দিয়ে বলি আপনার ম্যাডাম আপনার নাম লিখে পাঠিয়েছে এটা, সে তখন লজ্জামিশ্রিত যে হাসিটা দেয় তা অমূল্য। স্কুল চলাকালীন আমাদের স্কুলে সারাদিন যতবার ‘আজিজ মামা’ ডাকা হয় ততবার আর কারও নামই ডাকা হয় না। আর এ থেকেই বোঝা যায়, আজিজ মিয়া আমাদের স্কুল পরিবারের কত গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য। আজিজ মিয়া আমাদের মাঝে শত বছর বেঁচে থাকুন এবং আদর-ভালবাসায় আমাদের স্কুলকে আগলে রাখুন।

Leave a Reply